শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৪ পূর্বাহ্ন

কলকাঠি নাড়ছেন ট্যানারি মালিকরা

কলকাঠি নাড়ছেন ট্যানারি মালিকরা

স্বদেশ ডেস্ক:

কোরবানির চামড়া নিয়ে আড়তদারদের কারসাজি চরমে ঠেকেছে। আড়ালে থেকে অবশ্য এর কলকাঠি নাড়ছেন মূল ক্রেতা ট্যানারি মালিকরা। আগে থেকেই তারা আড়তদারদের বলে দেনÑ আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা নেই, তাই কম দামে কিনতে হবে। সেই অনুযায়ীই চিত্রনাট্য সাজান আড়তদাররা। প্রকৃত হকদারদের ঠকাতে আঁটেন নানা ধরনের ফন্দি। সরকার নির্ধারিত দাম না দেওয়ার জন্য প্রতিবছরই তাদের বলতে শোনা যায়Ñ আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কম, ট্যানারি মালিকরা দাম দেয় না। আবার সরকার নির্ধারিত দামে ফুট হিসেবে ট্যানারি মালিকদের কাছে তারা চামড়া বিক্রি করলেও মাঠ থেকে কেনেন পিস হিসেবে। এখানেই মূলত কারসাজির কেন্দ্রবিন্দু। একই সুযোগ নেন মৌসুমি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ফড়িয়ারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোথাও ফুট হিসেবে কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়নি এবারও। সবখানেই আড়তদাররা কিনেছেন পিস হিসেবে। কয়েক বছর ধরে চামড়ার দাম না থাকায় কোরবানিদাতারাও আর তা বিক্রি করেন না; সরাসরি দান হিসেবে দিয়ে দেওয়া হয় মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে। এর ফলে হক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কোরবানিদাতার গরিব আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা। এর পরই ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। হকদার এসব প্রতিষ্ঠান বলছে, শুরুতেই ফুট হিসেবে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা উচিত। তা হলে ন্যায্যমূল্য পাওয়া সম্ভব। কিন্তু সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম ফুট হিসেবে নির্ধারণ করায় আড়তদাররা এ সুযোগে গরিবের ওপর অবিচার করেন।

জানা যায়, এবার ফড়িয়াদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। তাই প্রতিযোগিতা না থাকায় গরুর চামড়া অনেক কম দামেই বিক্রি হয়েছে। ছাগলের চামড়ার অবস্থা ছিল বেশি খারাপ, যার বেশিরভাগই আড়তদারদের ফ্রিতে দিয়ে গেছেন খুচরা বিক্রেতারা। অনেক জায়গায় তো ফেলেই দেওয়া হয়েছে। গরুর চামড়াও কিছু নষ্ট হয়েছে কোথাও কোথাও। অথচ গতবারের চেয়ে এবার দাম কিছুটা বেশি-ই নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার।

চামড়ার স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারদর, চাহিদা, সরবরাহ ও রপ্তানির সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ঈদুল আজহার আগে ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে কোরবানির পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সারাদেশে খাসির ১৫ থেকে ১৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারিত ছিল। অথচ ঢাকায় গরুর চামড়া গড়ে ১৫ থেকে ২৫ টাকা বর্গফুটে বিক্রি হয়েছে। আর সারাদেশে ফুটের বদলে প্রতিটি গরুর চামড়া গড়ে ১০০ থেকে ৪০০ টাকায় কিনেছেন আড়তদাররা। সাধারণত গরুর চামড়া ১৫ থেকে ৪০ বর্গফুট পর্যন্ত হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন, একটি চামড়ায় ৬০ থেকে ৭০ টাকার লবণ দিতে হয়। এর সঙ্গে শ্রমিকের মজুরি ও পরিবহন খরচ গড়ে ৭০ থেকে ৮০ টাকা ব্যয় হয়। আড়ত ও ট্যানারিগুলোর মোট খরচ ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা। এসব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বর্গফুট চামড়ার দর প্রথম স্তরে ঢাকায় হওয়া উচিত অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ টাকা।

দেশের সর্ববৃহৎ কেনাবেচার হাট রাজধানীর পোস্তার আড়তগুলোতে প্রতিটি ছোট চামড়া ৩০০ থেকে ৪০০ ও বড় চামড়া ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আকারে অনেক বড় চামড়া ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা দর দিয়েছেন আড়তদাররা। এগুলো তারা লবণ দিয়ে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান। হাজারীবাগের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সাব্বির আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রতিবছর বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া কিনলেও এবার আর সেটি হয়নি। মসজিদ ও মাদ্রাসা থেকে একসঙ্গে ৩০০ চামড়া কিনেছি। গড়ে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত দাম পড়েছে। এতে প্রতি বর্গফুটের দাম পড়েছে ১৬ থেকে ২৪ টাকা। এ চামড়া পোস্তার আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের কাছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করেছি। প্রতিটিতে লাভ হয়েছে ১০০ টাকার মতো।’ যদিও সরকার নির্ধারিত দর অনুযায়ী ঢাকায় প্রতিটি লবণযুক্ত ৩০ বর্গফুট গরুর চামড়া ১ হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। আর লবণ, শ্রমিকের মজুরি ও পরিবহন মিলে সব খরচ ১৫০ টাকা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের গড়ে ১০০ টাকা লাভ ধরলেও প্রথম ধাপে কোরবানিদাতা কিংবা মসজিদ-মাদ্রাসা থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় কেনার কথা প্রতিটি চামড়া। কিন্তু বেচাকেনা হয়েছে তার অর্ধেক কিংবা তারও কম দামে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত দামের সঙ্গে সমন্বয় করে আড়তদারদের চামড়া কেনার কথা। কিন্তু প্রতিবছরই কম দামে কেনার অভিযোগ আসে তাদের বিরুদ্ধে। ট্যানারি মালিকরা তো তাদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত দামেই চামড়া কেনে।’ বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান আমাদের সময়কে অবশ্য বলেন, ‘পিস হিসেবে চামড়া কিনলেও ন্যায্যমূলে কেনার জন্য আড়তদারদের অনুরোধ করা হয়েছে। আমার কাছে তেমন অভিযোগ আসেনি। এ বছর গত বছরের তুলনায় বেশি দামেই আড়তদাররা চামড়া কিনেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কম। তাই ট্যানারিগুলো আগের মতো চামড়া নিতে চায় না। অনেক আড়তে তো আগের চামড়াই পড়ে আছে।’

সংশোধনী : গতকাল দৈনিক আমাদের সময়ের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘এবারও গরিবের হক চামড়া পানির দামে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে ‘১০ লাখ টাকার গরুর চামড়াটাও সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা যায় আড়তে, যা ছয়-সাত দিন আগেও বিক্রি হতো ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায়।’ এখানে ছয়-সাত দিনের স্থলে, ছয়-সাত বছর হবে। অনাকাক্সিক্ষত এ ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877